একাদশ শ্রেণী বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার, পঞ্চম অধ্যায় নুন - জয় গোস্বামী প্রশ্ন উত্তর | Class 11, 1st semester Bengali, Fifth Chapter । WBCHSE । nun - joy goswami
শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে আমরা আলোচনা করবো একাদশ শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের পঞ্চম অধ্যায় নুন - জয় গোস্বামী নিয়ে। আশাকরি তোমরা একাদশ শ্রেণীর দ্বিতীয় সেমিস্টারের এই নুন - জয় গোস্বামী অধ্যায়টি থেকে যেসব প্রশ্ন দেওয়া আছে তা কমন পেয়ে যাবে। আমরা এখানে একাদশ শ্রেণীর, দ্বিতীয় সেমিস্টারের বাংলা বিষয়ের পঞ্চম অধ্যায় নুন - জয় গোস্বামী এর SAQ, শূন্যস্থান পূরণ, এক কথায় উত্তর দাও, Descriptive, ব্যাখ্যা মুলক প্রশ্নোত্তর , সংক্ষিপ্ত নোট এগুলি দিয়েছি। এর পরেও তোমাদের এই নুন - জয় গোস্বামী অধ্যায়টি থেকে কোন অসুবিধা থাকলে, তোমরা আমাদের টেলিগ্রাম, হোয়াটসাপ , ও ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে রাখতে পারো ।
নুন - জয় গোস্বামী অধ্যায়ের সকল প্রশ্ন ও উত্তরঅনধিক ১৫০ শব্দে উত্তর:- দাও। প্রতিটি প্রশ্নের মান ৫
প্রশ্ন ১
"রাগ চড়ে আমার মাথায়, আমি তার মাথায় চড়ি," -বক্তার এই আচরণের স্বরূপ ব্যাখ্যা করো।
অথবা,
পঙ্ক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
অথবা,
বক্তার এমন আচরণের কারণ কী?
উত্তর:-
স্বরূপ তাৎপর্য/আচরণের কারণ শ্রমজীবী মানুষের প্রাত্যহিক কাজ নির্ভর করে মালিক তথা ধনিক শ্রেণির হাতে। ফলে কাজ না হওয়ার সঙ্গে অনাহারের সম্বন্ধ হয়ে পড়ে তাদের কাছে নিত্যসম্বন্ধী বিষয়। তার উপর এই শ্রেণির মানুষ ভীষণ অমিতব্যয়ী ও অপরিণামদর্শী। আগামী দিনের ব্যাপারে কোনো আগাম ধারণা করে আজকের উপার্জন থেকে কিছুটা সঞ্চয় রাখতে তারা উদ্যোগী হয় না। বরং কোনোভাবে অতিরিক্ত উপার্জিত হলে তারা মাত্রাছাড়া বাজার করার সঙ্গে গোলাপচারা কিনে আনে। তারা ভেবে দেখে না-চারাটি কোথায় পুঁতবে? কীভাবে পরিচর্যা করবে? তাতে আদৌ ফুল ফুটবে কি না ইত্যাদি। আর যখনই এই ভাবনা মনে ঢোকে তখনই ভেতরে ভেতরে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়।
মনের সেই দ্বিধা থেকে চরম অশান্তি ও অস্থিরচিত্ততা আসে। তারপর উপার্জনহীন দিনে দুপুররাতে বাড়ি ফিরে দ্যাখে ঠান্ডা ভাতে নুনটুকুও নেই। ফলে মাথায় রাগ চড়ে-বাবার সঙ্গে ক্রোধে উন্মত্ত দুই ভাইয়ের মতো কলহে লিপ্ত হয়। এইসময় প্রতিবেশীদের ভাবনাটুকু রাগের আগুনে পুড়ে ছাই হয়। চিৎকার-কলহে ক্রোধ ও তার প্রকাশ ক্রমশ বেড়ে যায়। পরিশেষে নিজেরাই বুঝিয়ে দেয় তাদের সামান্যতম চাহিদার কারণ ও স্বরূপ। তারা সামান্য লোক, তারা তাদের ঠান্ডা ভাতে সামান্য লবণের ব্যবস্থাই চায়। এটা হলে মাথায় রাগ চড়বে না-প্রতিবেশীরাও নিশ্চিন্ত থাকবেন।
প্রশ্ন ২
"সবদিন হয় না বাজার, হলে হয় মাত্রাছাড়া”-বক্তার সবদিন বাজার না-হওয়ার কারণ কী? মাত্রাছাড়া' বাজার হওয়া ব্যাপারটি কী বুঝিয়ে দাও। ২+৩=৫
উত্তর:-
◇ সবদিন বাজার না হওয়ার কারণ:
জয় গোস্বামীর 'নুন' কবিতা থেকে নেওয়া পঙ্ক্তিটির কথকের সবদিন বাজার না হওয়ার প্রথম ও প্রধান কারণ তাদের অমিতব্যয়িতা ও অপরিণামদর্শিতা। শ্রমজীবী এই মানুষ মূলত দিন আনা দিন খাওয়া গোত্রের। আগাম কোনো বিরূপতা- তাদের শারীরিক ক্ষমতা কমতে পারে কিংবা উপার্জন না হওয়া-এসব নিয়ে তারা ভাবে না। বরং তারা আজকের দিনকে ভালো করে ভোগ করার জন্য সব উপার্জন খরচ করে। আগামীদিনের সম্ভাব্য অনুপার্জনের জন্য তাদের সবদিন বাজার হয় না।
◇ 'মাত্রাছাড়া বাজার' কী:
মাত্রাছাড়া বাজার' কথাটির সহজ অর্থ হল অনাবশ্যক, অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা। বিশেষ করে হাতে উদ্বৃত্ত পয়সা জমা হওয়ার দিনে বক্তা এমন অবিবেচকের মতো কাজ করে ফেলে। মনে আবেগসর্বস্ব ভাবনার উদ্রেক ঘটে। ঘরে বসে গোলাপের সৌন্দর্য ও ঘ্রাণ পাওয়ার আশায় সে পরিকল্পনা ছাড়া গোলাপচারা কিনে আনে। কোথায় চারাটি পুঁতবে, পরিচর্যার কোনো সময় বা পদ্ধতি পাবে কিনা, এমনকি গাছটিতে আদৌ ফুল হবে কি না, তাও অজানা। অতএব অনিশ্চয়তা ও দ্বিধা তার মনকে আক্রমণ করে। ফলে বোঝা যায় হাতে অতিরিক্ত পয়সা থাকায় গোলাপচারা কেনার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি কিছু দুশ্চিন্তা তার মাথায় ঢোকে। আর এই দুশ্চিন্তার মেঘ সরাতে বক্তা গাঁজার বুঁদ হয়ে পড়ে। আর সেটিও তাকে কিনতে হয়। এসবই তার প্রয়োজন অতিরিক্ত জিনিস, তাই মাত্রাছাড়া বাজার।
প্রশ্ন ৩ 'নুন' কবিতার মূল বক্তব্য সংক্ষেপে নিজের ভাষায় লেখো। ৫
উত্তর:-
◇ 'নুন' কবিতার মূল বক্তব্য:
জয় গোস্বামীর 'নুন' কবিতাটি নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনবেদ। তারা অল্পতেই খুশি থাকে। অভাবী সংসারে অসুখবিসুখ-সহ ধারদেনায় জীবন কাটায়। এসব নিয়ে তাদের দুঃখ নেই। শত অভাবের মধ্যেও তারা মনে পুষে রাখে অনাবিল সৌন্দর্যবোধ। ফলে বাজার করার সঙ্গে সঙ্গে আগাপাছতলা না ভেবে গোলাপচারা কিনে আনে। অথচ তারা জানে না, তাতে ফুল হবে কি না। আসলে এই শ্রেণির মানুষ জীবন নিয়ে ভাবিত নয়। তারা কেবল আপাত ও তাৎক্ষণিক আবশ্যিক প্রয়োজন টুকুই বোঝে। তাই উপার্জনহীন দিনে দুপুররাতে ঘরে ফিরে ঠান্ডা ভাতে নুন না পেয়ে তারা অতিশয় বিরক্ত হয়। মাথায় রাগ চড়ে যায়। গঞ্জিকায় টান দিয়ে তারা স্বাভাবিক বোধবুদ্ধর বাইরে থাকে। এমতাবস্থায় গাঁজার নেশায় স্থানকালপাত্র অগ্রাহ্য করে বাপব্যাটায় স্বার্থান্ধ দু-ভাইয়ের মতো ঝগড়ায় মত্ত হয়। প্রতিবেশীরা তাদের ধর্তব্যের মধ্যে থাকে না। বেপরোয়াভাবে ঘোষণা করে-"করি তো কার তাতে কী?"
পাঠ্য 'নুন' কবিতায় কবি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে দীর্ণ নিম্নবিত্ত মানুষের ছোটো ছোটো সুখ, স্বপ্ন ও প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন। আর সেখানে তাদের একটাই প্রত্যাশা- "আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।”
প্রশ্ন ৪
"আমরা তো সামান্য লোক,”- 'সামান্য লোক' কারা? তারা নিজেদেরকে এমন বিশেষণ বা অভিধা দিয়েছেন কেন? ৩+২=৫
উত্তর:-
◇ সামান্য লোক যারা:
জয় জ গোস্বামীর 'নুন' কবিতার এই পঙ্ক্তির 'সামান্য লোক' শব্দটি কতিপয় বা কম সংখ্যক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। মূলত আর্থিক অনটনে ক্লিষ্ট নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এই শ্রেণির মানুষ অল্পে খুশি এবং অসুখে ধারদেনার মধ্যে জীবন কাটালেও জগৎ ও জীবন সম্পর্কে একটা পবিত্র ধারণা পোষণ করে। আবার ধারদেনায় কষ্টসৃষ্টে জীবনযাপন করলেও দৈনন্দিন জীবনে এরা কমবেশি মাদকাসক্ত থাকে। উপার্জনহীন অবস্থায় গভীর রাতে বাড়ি ফিরে ঠান্ডাভাতে নুন না পেয়ে বাবা-ছেলে মিলে প্রচন্ড ঝগড়া করে সারাপাড়া মাথায় তোলে। প্রতিবেশীদের চরম বিরক্তির কারণ হয়েও সদম্ভে বলতে পারে-ঝগড়া করি তো অন্য সবার কী যায় আসে। এই অবস্থায় সমাজে তারা নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে তারা সমাজের গণ্যমান্য অভিজাত মানুষ নয়, তারা কেবল ঠান্ডাভাতে লবণের প্রত্যাশী অনভিজাত নিম্নবিত্তের সাধারণ মানুষ-সামান্য লোক।' লোক।
◇ এমন অভিধার কারণ:
নিজেদের 'সামান্য লোক' অভিধায় ভূষিত করার প্রথম ও প্রধান কারণ ক্ষুধার জ্বালা। সামাজিক বৈষম্য ও আর্থিক দুর্বলতার জন্য কোথাও ন্যূনতম মানবিক সম্মান পায় না। অথচ এদের পরিশ্রমের ফসলে অভিজাতদের বিলাস-বৈভব। সবকিছু জেনেও ক্ষমতাহীনতার জন্য এরা দুর্বল ও অসহায়। আর এই চরম অসহায়তা থেকে নিম্নবিত্তের শ্রমজীবী মানুষ নিজেদেরকে 'সামান্য লোক' অভিধায় ভূষিত করে।
প্রশ্ন ৫
'নুন' কবিতায় কবি নিম্নবিত্ত মানুষের যে জীবনবোধের পরিচয় দিয়েছেন তা পরিস্ফুট করো। ৫
উত্তর:-
◇ 'নুন' কবিতায় সাধারণ মানুষের জীবনবোধ :
নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনবোধের কথা বলতে কবি জয় গোস্বামী 'নুন' কবিতায় বলেছেন-এরা অল্পে খুশি। এদের অতিরিক্ত কোনো চাহিদা নেই-সাধারণ ভাতকাপড়ে কষ্টেসৃষ্টে, ধারদেনা করে দিনযাপন করে। দারিদ্র্যপীড়িত নিত্যকার এই কষ্টবহুল যাপিত জীবনের মধ্যেও তারা সৌন্দর্যবোধ বাঁচিয়ে রাখে। আগামীর সুস্থির ভাবনা এইসব মানুষের নেই। ফলে মাত্রাছাড়া বাজারের দিনে তারা অনাবশ্যক গোলাপচারা কিনে আনে। অথচ সবদিন তারা বাজার করতে পারে না। পিতা ও পুত্রের মধ্যেকার সম্ভ্রমাত্মক দূরত্ব বা বন্ধুত্ব এরা বজায় রাখতে পারে না। ফলে ঠান্ডা ভাতে নুন না পেয়ে দুপুররাতে তারা তীব্র কলহে মেতে ওঠে। এসময় তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কারো বিষয়ে ভাবে না। পাড়া-প্রতিবেশী-সহ স্থানকালপাত্র সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলে-"করি তো কার তাতে কী?” এরপরেই সমাজে নিজেদের স্থান স্পষ্ট করে জানায় যে, তারা 'সামান্য লোক'। আর তাদের একটাই চাহিদা তাদের শুকনে ভাতে লবণের, পরিপূরণ। আসলে নিম্নবিত্ত মানুষের যাপিত জীবনে, জীবনবোধ নির্দিষ্ট একটা বৃত্তেই আবর্তন করে। আর তা হল-অল্পে খুশি থাকা, অবিবেচনার আবেগে অনাবশ্যক খরচ, সঞ্চয়হীন মানসিকতা, আনন্দে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা, দৈনন্দিন দুঃখযন্ত্রণা ভুলতে নেশায় মত্ত হওয়া এবং প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করার মানসিকতা।
প্রশ্ন ৬
ও "আমরা তো অল্পে খুশি, কী হবে দুঃখ করে?"- শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতিনিধি কবির এমন কথা বলার কারণ কী? ৫
উত্তর:-
◇ নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতিলিপি হিসেবে কবি:
'নুন' কবিতার কবি জয় গোস্বামী নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিরূপে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও জীবন-যাপনের স্বরূপ কবিতায় তুলে ধরেছেন। তারা হাজারো অপ্রাপ্তির মধ্যে জীবনকে পূর্ণরূপে উপভোগ করতে চায়। তাই অসুখ, ধারদেনা আর কষ্টেসৃষ্টে তাদের দিন অতিবাহিত করে। সৌন্দর্যবোধের আবেগে মাত্রাছাড়া বাজার করার পাশাপাশি গোলাপচারাও কেনে। অথচ তারা জানে না, গাছে ফুল ফুটবে কি না! তাদের উপার্জন অনিশ্চিত, তা সত্ত্বেও নিত্যদিনের দীনতা ভুলে থাকতে তারা নেশায় ডুবে যায়। তারা বাপব্যাটার সম্ভ্রমাত্মক দূরত্ব ভুলে স্বার্থান্ধ দু-ভাইয়ের মতো কলহে লিপ্ত হয়। এ ব্যাপারে পাড়াপ্রতিবেশীরা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। আর এখানে উদ্ধৃত পক্তিটির অর্থ আরও যন্ত্রণাবহ হয়ে ওঠে। কথকের অন্তর্বেদনা যেন তীব্রতা-সহ প্রবাহিত হয়ে সহৃদয় পাঠকচিত্তে আঘাত করে। পাঠকও কবির উপলব্ধির সঙ্গে একাত্ম হয়ে শ্রমজীবী মানুষদের জন্য সকাতর হয়ে ওঠেন এবং সাধারণ এই শ্রেণির মানুষদের জন্য শোষক, শাসক ও উচ্চবিত্তদের কাছে বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপকরণটির দাবি জানায়। এতসব প্রতিকূলতার মধ্যে তারা সমাজের কাছে কেবল ঠান্ডা ভাতে লবণের ব্যবস্থা করার প্রত্যাশা রাখে। আসলে তাদের চাহিদা লোভী, নির্মম উচ্চবিত্ত মানুষের মতো নয়। তারা সীমিত প্রত্যাশায় নিজেদের সীমাবদ্ধ করে জীবনযাপনের মাধুর্য উপভোগ করতে সক্ষম বলেই নিম্নবিত্তের প্রতিনিধি কবি এমন উচ্চারণ করেছেন।
প্রশ্ন ৭
"আমরা তো এতেই খুশি; বলো আর অধিক কে চায়?"-উদ্ধৃতির আলোয় নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপনের চিত্র বর্ণনা করো। ৫
উত্তর:-
◇ 'নুন' কবিতায় নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার চিত্র:
সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ সাধারণ ভাতকাপড়ে খুশি। শুধু তা-ই নয়, তারা কষ্ট করে উপার্জন করে যা পায়, তা যতই কম হোক সেই অল্পেই খুশি। এর সঙ্গে তাদের জীবনের স্বরূপ পাঠক উপলব্ধি করে। আমরাও বুঝতে পারি এই শ্রেণির মানুষ বিলাসিতা ও আভিজাত্যের পেছনে ছোটে না। বরং তারা নিত্যকার অভাব, দারিদ্র্য, অসুখ, ধারদেনা মেনে নিয়ে কোনোমতে দিন কাটিয়ে দেয়। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যভাবনার প্রকাশ তারা দেখায় গোলাপচারা কিনে। তাও যেদিন বেশি পয়সা হাতে আসায় মাত্রা ছাড়া বাজার করে। খুশির আতিশয্যে নেশার দ্রব্য গাঁজায় টান দেয়। অবশ্য গাঁজা খাওয়ার জন্য তাদের অন্য প্রেক্ষিতও আছে। নিত্যকার দুঃখযন্ত্রণা-কষ্ট থেকে সাময়িক রেহাই পেতেও তারা এ কাজ করে। অসহনীয় ঠান্ডা ভাতে নুন না পাওয়ায় রাতে তারা ভীষণ রেগে যায়। বাপব্যাটা দুই স্বার্থান্ধ ভাইয়ের মতো কলহে মত্ত হয়। পাড়াপ্রতিবেশীদের পর্যন্ত তারা গ্রাহ্য করে না। শেষ অবধি সমাজের কাছে ঠান্ডা ভাতে লবণের ব্যবস্থার কথা বলে তারা ক্ষান্ত হয়। আসলে খুশি থাকার প্রচুর উপাদান আশেপাশে থাকলেও জীবন বাঁচিয়ে রাখার ন্যূনতম উপাদান প্রাপ্তির মধ্যেও তারা খুঁজে নেয় খুশি।
প্রশ্ন ৮
"আমরা তো অল্পে খুশি;"-'আমরা' বলতে কবি কাদের বুঝিয়েছেন? তাদের 'অল্পে খুশি' থাকার কারণ ব্যাখ্যা করো। ২+৩=৫
উত্তর:-
◇ যাদের বোঝানো হয়েছে:
কবি জয় গোস্বামীর 'নুন' কবিতার উদ্ধৃত এই পঙ্ক্তিতে 'আমরা' বলতে কবি সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত নিম্নবিত্ত মানুষদেরকে বুঝিয়েছেন। এই শ্রেণির মানুষ সামাজিক নানান বৈষম্যের শিকার হয়ে অতি সাধারণভাবে দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে চলে। প্রতিদিনের ন্যূনতম বাঁচার রসদ জোগাড় করে কঠোর কায়িক পরিশ্রম করে। এতসব প্রচেষ্টার পরেও এই 'আমরা' শ্রেণির মানুষ ঠান্ডা ভাতে লবণটুকু জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়।
◇ 'অল্পে খুশি' থাকার কারণ:
সমাজের নিম্নবিত্তের মানুষ হাজারও বৈষম্যের শিকার। বিশেষ করে আবহমানকালের ধনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এই শ্রেণির মানুষ কোনোদিন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে না। ফলে বেঁচে থাকার জন্য এরা সমাজের উচ্চবিত্ত, অভিজাত ও ধনিকগোষ্ঠীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতেও এদের কোনো সুরাহা নেই। এমনকি শিক্ষা ও সচেতনতা না থাকার দরুন নিম্নবিত্ত এই শ্রমজীবী পরিশ্রমী মানুষ কোনোকালে নিজেদের অধিকারটুকু বুঝে নিতে পারে না। কেবল নিজেদের দুর্ভাগ্যের জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করেই গতানুগতিকভাবে জীবন কাটাতে তৎপর থাকে, ভাগ্য বদলের কথা ভাবে না। তা ছাড়া উচ্চবিত্তের চিরকালীন শোষণ কৌশলের কাছে সম্পূর্ণ পরাস্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে, তারা আমরণ 'অল্পে খুশি' থাকার গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে।
প্রশ্ন ৯
'নুন' একটি শিল্পসার্থক কবিতা-আলোচনা করো। ৫
উত্তর:-
'নুন' কবিতার শিল্প সার্থকতা:
যে-কোনো সাহিত্য প্রকরণ শিল্পসার্থক হয়ে ওঠে তার বিষয়বস্তু, পরিবেশন কৌশল বা ভঙ্গি, ভাষা ব্যবহার এবং সর্বোপরি লেখকের সমাজবীক্ষণের দক্ষতা ও তার প্রকাশ। আর এই সব বিষয়ে জয় গোস্বামীর সীমাহীন পারঙ্গমতা। কবিতাটি সাধারণভাবে নিম্নবিত্ত সমাজ-মানুষের চিরন্তন ভাবধারা, জীবনযাপন পদ্ধতি বহন করে। আপাত সৌন্দর্য ভাবনা ও আদর্শ বুকে নিয়ে তারা দিনরাত পরিশ্রম করেও ভালোভাবে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করতে পারে না। অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে চিরাচরিত পথে চলতে থাকে। আর তার মধ্যে তারা খুঁজে নেয় খুশি। মাঝে মাঝে ক্ষুব্ধ হয় ঠিকই কিন্তু প্রতিকার করতে অক্ষম। বরং সবকিছু ভুলে থাকার বাসনায় তারা নেশায় বিভোর হয়ে পড়ে। রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে বাপব্যাটায় ঝগড়া করে।
প্রতিবেশীরা বিরক্ত হয় কিন্তু তারা ধর্তব্যের মধ্যে রাখে না। অথচ তারা সমাজের সামান্য লোক হয়েও যথেষ্ট গর্ববোধ করে। আসলে তারা চায় বেঁচে থাকার ন্যূনতম খাবার ভাত ও নুনটুকুর অধিকার। কবি তাদের এই চাওয়াকে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের চাওয়ার বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। কবির ব্যবহৃত ভাষা, ছন্দ ও অলংকার সবই সাধারণ পাঠকের কাছে সহজবোধ্য। তাঁর পরিবেশন- ভঙ্গিমা ও সমাজবীক্ষণের পারঙ্গমতা মননশীল পাঠকের সপ্রশংস সাধুবাদের দাবিদার। ফলে সব দিক দিয়ে আমরা বলতেই পারি 'নুন' কবিতাটি কবির অন্য সবই সৃষ্টির মতোই শিল্পসার্থক কবিতা।
প্রশ্ন ১০
"নুন' কবিতাটি সমাজসচেতন মানবিক মানুষের মানসিক টানাপোড়েনের যন্ত্রণায় বিদ্ধ কবিতা।"- আলোচনা করো। ৫
উত্তর:-
◇ 'নুন' কবিতায় সমাজচেতন মানুষের মানসিক টানাপোড়েন:
মানুষমাত্রই মানবধর্মিতায় ঋদ্ধ সামাজিক হবে- এটাই প্রত্যাশিত। বাস্তবে যে তার ব্যতিক্রম নেই, তা নয়। তবুও একথা বলতেই হয়, সমাজ সচেতন মানবিক মানুষ সমাজের বৈষম্যে যন্ত্রণাবিদ্ধ হবেই। তা সে যত রকমের বৈষম্য হোক না কেন। স্বার্থান্ধ লোভী মানুষ মানবধর্মিতা ব্যাপারটি উপেক্ষা করলেও হৃদয়বান কবি তা পারেন না। বরং সেই টানাপোড়েনকে আত্মস্থ করে নিজে তা সার্বিক করে তোলেন। প্রকাশ করেন তাঁর সৃষ্টিশীল রচনায়। জয় গোস্বামী তাঁর 'নুন' কবিতায় ঠিক এই কাজটিই করেছেন। নিম্নবিত্ত দারিদ্র্যপীড়িত চিরবঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক চাহিদার কথাই তিনি 'নুন' কবিতায় তুলে ধরেছেন। তার সঙ্গে সেই মানুষের ভেতরে লুকিয়ে-থাকা সৌন্দর্যচেতনা, দুঃখ ভুলে থাকার জন্য নেশাগ্রস্ততা, রাগের হেতুতে প্রতিবেশীদের অগ্রাহ্য করা, স্থানকালপাত্র ভুলে ভয়ানক ক্ষিপ্ত হওয়া, দু-ভাইয়ের মতো বাপব্যাটার উন্মত্ত লিপ্ত হওয়া-সবই সেই মানবিক সমাজসচেতন মানুষের মানসিক টানাপোড়েনের কথাই জানায়। আর কবি পুরো ব্যাপারটি সত্যদ্রষ্টার মতো প্রত্যক্ষ করে তা কবিতায় ফুটিয়ে তোলেন। সুতরাং 'নুন' কবিতাটি সমাজসচেতন মানবিক মানুষের মানসিক টানাপোড়েনের যন্ত্রণায় বিদ্ধ কবিতা।
প্রশ্ন ১১
"আমাদের দিনে চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে।”- 'সাধারণ ভাতকাপড়' বলতে কী বোঝায়? কথাটির মাধ্যমে সমাজে টিকে থাকার প্রবল বৈষম্যের দিকটি ফুটিয়ে তোলো। ২+৩=৫
উত্তর:-
'সাধারণ ভাতকাপড়ের' পরিচয়:
'সাধারণ ভাতকাপড়' কথাটির সাধারণ অর্থ কোনোমতে খেয়ে-পরে জীবনে বেঁচে থাকা। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই এভাবেই বাঁচে, বলা যায় টিকে থাকে। এমনতর জীবনযাপনে প্রতিমুহূর্তে স্বপ্ন-সাধ- বিলাসভাবনা অবদমিত থাকে। সাধের সঙ্গে সাধ্যের আকাশ- পাতাল ফারাক থাকায় সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ এভাবেই জীবনে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যায়। আধুনিক সভ্যতার নাগপাশে সমাজের বৈশিষ্ট্য-বিভেদের কারণে নিম্নবিত্ত মানুষের এই দৈনন্দিন টিকে থাকার সংগ্রামে একমুঠো খেয়ে, কোনোমতে লজ্জা বাঁচিয়ে প্রাণে বেঁচে থাকার বিষয়কেই কবি জয় গোস্বামীর 'নুন' কবিতায় 'সাধারণ ভাতকাপড়' বোঝানো হয়েছে।
◇ সমাজের বৈষম্যের দিক:
আধুনিক শিল্পোন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বৈষম্য সবচেয়ে প্রকট। আজ শাসনব্যবস্থা এমনভাবে পরিচালিত হচ্ছে যে, একশ্রেণির মানুষ বিলাসব্যসন-ঐশ্বর্যে বিত্তবান হয়ে উঠছে, অন্যদিকে অন্যশ্রেণির মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। অথচ দরিদ্রের কঠোর পরিশ্রমেই ধনিক শ্রেণির বিত্তের পাহাড় গড়ে ওঠে। তাদের অতুল বৈভবের নীচে শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম আহার্য পর্যন্ত চাপা থাকে। ফলে পরিশ্রমী দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষগুলি বেঁচে থাকার সামান্যতম আহারসামগ্রী জোগাড় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা ক্ষুধায় কাতর হয়ে শীর্ণ দেহে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় দিনপাত করে। একদিকে উচ্চবিত্তের জৌলুস-ঐশ্বর্যের মহাসমারোহ, অন্যদিকে ঠান্ডাভাতে নুন না- পাওয়ার ক্ষোভে অকারণ চিৎকার-করা নিম্নবিত্তের 'সাধারণ ভাতকাপড়ে' দিন চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে কবি তাই সমাজের প্রবল বৈষম্যের দিকটিকেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
প্রশ্ন ১২
নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবন যন্ত্রণার যে ছবি 'নুন' কবিতায় পাওয়া যায় তা সংক্ষেপে লেখো। ৫
উত্তর:-
◇ 'নুন' কবিতায় শ্রমজীবী মানুষের জীবনযন্ত্রণার চিত্র :
মানুষমাত্রই বাঁচার অধিকারী। আর নিতান্ত সাধারণ-ভাবে বাঁচতে অবশ্যই চাই অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান। কিন্তু সবার আগে চাই অন্ন। কিন্তু শুধু অগ্নে তো হয় না, তাকে খাবার উপযোগী করতে চাই নুন-অর্থাৎ লবণ। নুন ব্যতীত শুধু নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর নয়-উচ্চবিত্ত-সহ অন্য সব মানুষের জীবনের স্বাদ থাকে না। শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত মানুষ, তাই ভাত আর নুনের জন্য লড়াই করে নিরন্তর। তাই কবিতার কথক ঠান্ডা ভাতে নুন না পেয়ে বাপব্যাটা রাতদুপুরে ঝগড়া করে পাড়া মাথায় করে প্রশ্ন তোলে-"করি তো কার তাতে কী"-কিংবা সামান্য লোক হিসেবে সমাজের কাছে দাবি জানায়- "আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।" আসলে শ্রমজীবী মানুষ নির্ঝঞ্ঝাট ঝামেলাহীন জীবন পছন্দ করে বলে তারা অল্পে খুশি থেকে সাধারণ ভাতকাপড়কে সম্বল করে অসুখে ধারদেনায় বেঁচেবর্তে থাকে। সেইসঙ্গে মনে স্বাভাবিক সৌন্দর্য সচেতনতা বজায় রেখে মাত্রাছাড়া বাজারের দিনে গোলাপচারা কিনে আনে এবং অকারণ দুশ্চিন্তার শিকার হয়। এটাও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবনযন্ত্রণার অন্য এক প্রতিচ্ছবি। এভাবে শ্রমজীবী মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে ঘরেবাইরে লড়াই করে নিজেদের যন্ত্রণাবহুল জীবনযাপনের ছবি ফুটিয়ে তোলে।
প্রশ্ন ১৩
"চলে যায় দিন আমাদের অসুখে ধারদেনাতে,”- বক্তার এমন অভিমতের কারণ কী? 'অসুখে ধার- দেনাতে' দিন চালানোর মাধ্যমে বক্তার চরিত্রের কোন্ দিকটি প্রকাশ পায়? ৩+২=৫
উত্তর:-
◇ বক্তার অভিমতের কারণ:
সমাজে 'অল্পে খুশি'-থাকা আর ধারদেনায় অসুখে-বিসুখে টিকে থাকা মানুষগুলি নিতান্ত নিম্নবিত্ত অতি সাধারণ শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ। এদের মধ্যে কোনোরকম কপটতা থাকে না-থাকে না অন্যকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয় শ্রেণির ভাবনায় উন্নীত হয়ে থিতু থাকার চেষ্টা। এই শ্রেণির মানসভূমিতে ব্যক্তিক ভাবনার চেয়ে সমষ্টির চেতনা প্রাধান্য পায় বলে হাজারও কষ্ট সহ্য করে জীবনে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যায়। শারীরিক পরিশ্রমই এদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু পরিশ্রমী হওয়া সত্ত্বেও নানান প্রতিবন্ধকতায় এরা হার মেনে সাময়িকভাবে ছুটি নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু পোড়া পেটের তো খাবার চাই। এ কারণেই 'নুন' কবিতার বক্তার এমন অভিমত।
◇ বক্তার চরিত্রের দিক:
'অসুখে ধারদেনাতে' দিন চালানোর মাধ্যমে বক্তার চরিত্রের প্রথম যে দিকটি প্রকাশ পায় তা হল জীবনধর্মিতা। বেঁচে থাকার প্রবল আগ্রহ নিয়ে তারা কাজ করে চলে। অল্পে খুশি থাকা মানুষগুলি সাধারণ ভাতকাপড় জোগাড় করতে গিয়ে প্রতিমুহূর্তে বাধার সম্মুখীন হয়। তবুও জীবনধর্মিতা বজায় রাখতে মনের ভেতর লুকিয়ে- থাকা সৌন্দর্য-সুন্দরকে প্রকাশ করতে তারা দ্বিধা করে না। কিছু অতিরিক্ত আয় হলে তারা আগে-পিছে না ভেবে গোলাপচারা কিনে আনে। তারা জীবনের স্বরূপ বোঝে বলেই জীবনের স্বাদ পেতে অসুখবিসুখে অবসন্ন হয়েও ধারদেনার দ্বারা কর্মজীবনে ফিরতে উদ্যোগী হয়।
প্রশ্ন ১৪
"কিন্তু পুতব কোথায়? ফুল কি হবেই তাতে?"-
কোন্ বিষয়ে বক্তার এই প্রশ্নাত্মক ও সন্দিগ্ধ মনোভাব? তার এই সংশয়াত্মক অভিব্যক্তির কারণ কী?২+৩=৫
উত্তর:-
◇ প্রশ্নাত্মক ও সন্দিগ্ধ মনোভাব :-
চিন্তাশীল মানুষের মধ্যে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সাধারণ কৌতূহল থাকে। এ ব্যাপারে নিম্নবিত্তদেরও নিজস্বতা থাকে। দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য তারা কঠোর লড়াইয়ের সঙ্গে জগতের সৌন্দর্যের প্রতিও আগ্রহী। সে-কারণে হাতে পয়সা এলে তারা গোলাপচারা কিনে আনে। অথচ তারা নিশ্চিত নয়-কোথায় সেই চারা পুঁতবে আর আদৌ তাতে ফুল হবে কি না। আসলে ব্যাপারটি তাদের নিত্যকার জীবনযাপন, উপার্জন হওয়া, না-হওয়া, খাবার জোটা বা না-জোটার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেই এমন মনোভাব।
◇ অভিব্যক্তির কারণ:
বক্তার এই সংশয়াত্মক অভিব্যক্তির কারণ হল তাদের দারিদ্র্য ও উপার্জনের অনিশ্চয়তা। নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ তাদের সার্বিক দুঃখযন্ত্রণার মধ্যেও মনের ভেতর লালন করে পরিশুদ্ধ সৌন্দর্যময় জীবনধর্মিতা। বাড়ি ফেরার পথে গোলাপচারা কিনে আনার মধ্যে আমরা তাদের সেই ভাবনারই প্রতিফলন দেখি। তাদের বৈশিষ্ট্য যেখানে অল্পে খুশি-থাকা, অসুখেবিসুখে, ধারদেনায় জীবন-কাটানো এবং নিতান্ত স্বার্থাধ মানুষের মতো সংকীর্ণ ভাবনায় আটকে-থাকা সেখানে গাছ লাগানোর স্থান ও পরিচর্যার বিষয় মাথায় না-রেখে গোলাপচারা কেনার বিষয়টি নিতান্তই অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। ফলে পরক্ষণেই মনের মধ্যে প্রবল সংশয় জন্ম নেয়। তার থেকেই আসে অজস্র প্রশ্ন। নিম্নবিত্তের শ্রমজীবী মানুষের এটাই সমস্যা-এরা ভেবে কাজ না করে করার পর সন্দিগ্ধ ও চিন্তাগ্রস্ত বেসামাল হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন ১৫
"সে অনেক পরের কথা। টান দিই গঞ্জিকাতে।”- কোন্ প্রসঙ্গে বক্তার এই উক্তি? সে গঞ্জিকাতেই-বা টান দেয় কেন? ২+৩=৫
উত্তর:-
◇ উক্তির প্রসঙ্গ:
জয় গোস্বামীর 'নুন' কবিতার এই উক্তিতে সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের স্বভাবজাত স্বাভাবিকতার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। এই শ্রেণির মানুষ নিজেদের চরম দারিদ্র্য সত্ত্বেও একটি পরিশুদ্ধ মানসিকতা বজায় রাখে। ফলে পেটের ভাত না থাকলেও তারা আবেগমথিত ভাবনায় বেশ কিছু কাজ করে ফেলে। কবিতার কথকও তেমন ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে গোলাপচারা কিনে আনে। অথচ কোথায় পুঁতবে, কীভাবে পরিচর্যা হবে, তাতে আদৌ ফুল হবে কি না, সে-ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। পরক্ষণেই মনকে প্রবোধ দিয়ে সংশয়মুক্ত হতে চাওয়ার প্রসঙ্গে কথাটি বলে।
◇ গঞ্জিকাতে টান দেওয়ার কারণ:
সৌন্দর্যচেতনার ভাবনাবিলাস নিম্নবিত্তের শ্রমজীবী মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ক্ষণে ক্ষণে আসে, আবার মিলিয়েও যায়। দূরের ভাবনা দূর অস্ত, অনতিদূরের ভাবনাকেও তারা বেশিক্ষণ টিকিয়ে রাখতে পারে না। বরং সাময়িক উত্তেজনাকর আকর্ষণীয় ভাবনায় তারা মশগুল থাকে বেশি। আর এটাই তাদের অধিকতর পছন্দের। এর জন্য তারা নেশার আশ্রয় নেয় এবং দৈনন্দিন অপ্রাপ্তি ভুলে থাকতে সাময়িকভাবে হলেও আবেশে-বিবশতায় নিস্পৃহ ও উদাসীন থাকতে আগ্রহী হয়। আসলে গাঁজা অর্থাৎ গঞ্জিকা একটি নেশার বস্তু, যা খেলে ব্যক্তি মনে করে, তার যাবতীয় ন দুঃখ-শোক দূর হবে। তাই জাগতিক দুঃখ- যন্ত্রণা ভোলার এ অভিপ্রায়ে গঞ্জিকায় টান দেয় এইসব নীচের মহলের মানুষরা।
প্রশ্ন ১৬
"রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দিই গঞ্জিকাতে"- কোন্ প্রেক্ষাপটে বস্তার এই উক্তি? এই আচরণ তাদের জীবনের কোন্ সত্য প্রকাশ করে লেখো। ২+৩=৫
উত্তর:-
◇ উক্তির প্রেক্ষাপট:
বর্তমান সময়ের বলিষ্ঠ কবি জয় গোস্বামীর 'নুন' কবিতা থেকে নেওয়া উদ্ধৃত উক্তির প্রেক্ষাপট হল আর্থিক বৈষম্য ভরা হতদরিদ্র সর্বহারা মানুষের অসহায়তা। একদিকে জীবনে চরম দৈন্য, অন্যদিকে নিত্য কাজ না-পাওয়া। এই শ্রেণির মানুষ মূলত দিন-আনা, দিন-খাওয়ায় অভ্যস্ত। আবার এসব দৈন্য থেকে সাময়িক স্বস্তি পেতে এরা নেশায় বুঁদ থাকতে পছন্দ করে। সুতরাং জীবনের সার্বিক আস্বাদ গ্রহণের প্রবল ইচ্ছার সঙ্গে সাধ্যের বা উপার্জনের বিস্তর ব্যবধান উপলব্ধি করেও ক্ষণিকের অলীক সাধ পূরণের প্রেক্ষাপটে বক্তার এই উক্তি।
◇ জীবনের সত্যতার দিক:
নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি 'নুন' কবিতার বক্তার কথার মধ্যে জীবনধর্মিতার সত্য প্রকাশিত হয়। আসলে তারা জীবনসংগ্রামে লড়াই করে টিকে থাকতে অভ্যস্ত। সাধারণ ভাতকাপড়ে অভ্যস্ত এই মানুষের যেমন দু-বেলা খাবার জোটে না, তেমনি শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ক্ষণিকের অলীক সাধ পূরণে এরা নেশা করে। আগামীকাল কাজ হবে কি না, উপার্জন হবে কি না, এসব ব্যাপার মাথায় রাখে না। এমনকি সামান্যতম সঞ্চয়ের কথা না ভেবে নিম্নবিত্তের এই বক্তা সমস্তই খরচ করে রাখে। ফলে বাজার না হওয়ার দিনে এদের কোনো উচ্চবাচ্য থাকে না- বরং এটাকেই নিজেদের অনিবার্য ভবিতব্য মনে করে। এরা আপাত ভাবনায় আবর্তিত হয়ে নিজেদের অপরিণামদর্শিতা ও অমিতব্যয়িতার জীবন ভাবনার সত্যটাকে 'গঞ্জিকাতে' টান দেওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ করে।
প্রশ্ন ১৭
মাঝে মাঝে চলেও না দিন, , বাড়ি ফিরি দুপুররাতে,"- কোন্ পরিপ্রেক্ষিতে কথাটি বলা হয়েছে? দুপুররাতে বাড়ি ফেরার পর কী ঘটে? ৩+২=৫
উত্তর:-
◇ পরিপ্রেক্ষিত:
জয় গোস্বামীর 'নুন' কবিতা থেকে নেওয়া প্রশ্নোক্ত উক্তিটির পরিপ্রেক্ষিত হল- নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপন প্রক্রিয়া। অবশ্য ব্যাপারটির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। একদিকে নিম্নবিত্ত মানুষের অসহনীয় নিরন্নপ্রায় জীবনযাপন, অন্যদিকে উচ্চবিত্ত মানুষের বিলাসবহুল জীবনচিত্র। নিম্নবিত্ত মানুষরা সম্পূর্ণভাবে শারীরিক পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল কাজ করে উপার্জন হলে এরা খেতে পায়, নতুবা অনাহার তাদের ভবিতব্য। এরা সঞ্চয়ে আগ্রহী নয়-ভবিষ্যতের কথা ভেবে গচ্ছিত রাখতে চায় না। বরং অতিরিক্ত কিছু পেলে মাত্রাতিরিক্ত বাজার করে। এমনকি আগুপিছু না ভেবে গোলাপচারা কিনে । পরক্ষণেই পরক্ষণেই মনে দ্বন্দ্ব জন্মায়-তা কোথায় লাগাবে? আনে।গ তাতে আদৌ ফুল হবে কি না? এমত পরিস্থিতিতে বাড়ির অন্যান্যদের থেকে নিজের অসহায়তা গোপন রাখতে এবং পাড়াপ্রতিবেশীদের থেকে নিজেদের দুরবস্থা লুকিয়ে রাখার পরিপ্রেক্ষিতে কথাটি বলা হয়েছে।
◇ দুপুররাতে ফেরার প্রতিফল:
দুপুররাতে বাড়ি ফিরে তারা চরম অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে। ঠান্ডা ভাতে নুন না পেয়ে বাপব্যাটা মিলে তুমুল কলহে লিপ্ত হয়। তখন পিতাপুত্রের স্বভাবে সম্ভ্রমাত্মক দূরত্ব থাকে না। স্বার্থান্ধ দুই ভাইয়ের মতো প্রতিবেশীদের আমল না দিয়ে সোচ্চারে বলে দেয়-"সারা পাড়া মাথায় করি" এবং "করি তো কার তাতে কী?” আসলে উপার্জনহীনতা জনিত ক্ষুধার যন্ত্রণায় তারা সাময়িক উন্মত্তের আচরণ করে।
প্রশ্ন ১৮
"বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গোলাপচারা"- কোন্ অবস্থায় বক্তা গোলাপচারা কিনে আনেন? তার এমন আচরণের কারণ ব্যাখ্যা করো। ২+৩=৫
উত্তর:-
◇ গোলাপচারা কেনার পশ্চাৎভূমি:
'নুন' কবিতার বক্তা সমাজের নিম্নবিত্ত সর্বহারা দিন-আনা, দিন-খাওয়া শ্রেণির প্রতিনিধি। এরা প্রতিদিন কাজে যায়, উপার্জন হলে বাজার করে ঘরে ফেরে। আর না-হলে অন্যের থেকে ধার করে কিংবা না-খেয়ে রাত কাটায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে এমনও দু-একটা দিন আসে অতিরিক্ত উপার্জনের সুযোগ হয়। এমনি একদিনে তাদের অতিরিক্ত বাজারের সঙ্গে দু-একটা গোলাপচারাও কেনা হয়ে যায়। ফলে মাত্রাছাড়া বাজারের দিনে বস্তা কোথায় সেই গাছ লাগাবেন তা না ভেবেই সৌন্দর্যচেতনা হেতু গোলাপচারা কিনে আনে।
◇ আচরণের কারণ ব্যাখ্যা:
জীবনধর্মিতা হল নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী অতি সাধারণ মানুষের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। তাদের আনন্দ, বেদনা, দুঃখ-সুখের মধ্যেও সৌন্দর্যচেতনা অমলিন থাকে। তাই দৈনন্দিন অভাব অনটনে গোলাপচারা কিনে আনার ভাবনা প্রাণে জিইয়ে রাখে। ব্যাপারটি যেমন তাদের বিমল-শুদ্ধ জীবনচেতনার প্রতিচ্ছবি, তেমনি এর মধ্যেই রয়েছে অপরিণামদর্শী ভাবনার ইঙ্গিত। আসলে সে জানে না গাছটি কোথায় লাগাবে, আর আদৌ তাতে ফুল ফুটবে কি না। এদিকে অসুখে, ধারদেনায় ও প্রায় অর্ধাহারে ঠান্ডা ভাতে নুন না-পেয়েও এরা দিন কাটায়। এসব নিয়ে তারা স্বার্থপর দু-ভায়ের মতো বাপ-ছেলেতে ঝগড়া করে। এসময় তাদের দিনরাতের বোধ ও প্রতিবেশীর কথা পর্যন্ত মনে থাকে না। তবুও এ কথা বলতে হয়-এতসব বিপন্নতার মধ্যেও তারা প্রাণের পূত-পবিত্র সৌন্দর্যচেতনার কারণে যথার্থ মানুষের মতো এই আচরণ করে মানবধর্মিতার প্রকাশ ঘটায়।